বিশ্বকে খাওয়ানো শ্রমিকদের অধিকার ও জীবিকা সুরক্ষা করা
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০
২০২০ সালের জুনে জাতিসংঘ সতর্ক করেছিল যে আমরা ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হচ্ছি।
কভিড-১৯ মহামারি প্রতিটি দেশে খাদ্য সরবরাহকে প্রভাবিত করেছে, মানুষের চলাচলে বাধা, পরিবহন ও বিতরণ ব্যহতকরণ এবং সীমান্ত বন্ধ হওয়ার ফলে খাদ্যের ঘাটতি এবং মূল্য বৃদ্ধি। শহরে খাবারের দাম বাড়ার সাথে সাথে মহামারিটি দূর্বল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি দারিদ্র্য ও ঋণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিবহন ও বিতরণে বিঘ্নিতকরণ, শহরগুলিতে ঘাটতি তৈরি করে এবং খামারে উৎপাদিত পণ্য উদ্বৃত্ত হয়ে কৃষি উপকরন এবং ফসলের বিক্রয় উভয়কেই প্রভাবিত করেছে। একদিকে উদ্বৃত্ত কৃষি পণ্যগুলি প্রচুর পরিমাণে ফেলে দেওয়া এবং ধ্বংস করা হয় অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায়। এই অঞ্চলজুড়ে কয়েক মিলিয়ন অনানুষ্ঠানিক খাতের হকাররা এবং গৃহ-ভিত্তিক খাদ্য শ্রমিক তাদের জীবিকা হারিয়েছেন। মৌসুমী এবং অভিবাসী শ্রমিকরা চলাচলে বাধার সম্মূখিন হয়, যার ফলে ক্ষেত, খামার এবং প্লান্টেশনে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয়। শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারের জন্য মজুরি ও জীবিকার এই প্রাণঘাতী ক্ষয়ক্ষতি তাদের ক্রমবর্ধমান মহামারিতে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
এই ক্রমবর্ধমান মহামারিতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, মাংস প্রক্রিয়াকরণ এবং পানীয় উৎপাদন শিল্পের শ্রমিকদের অপরিহার্য শ্রমিক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল – জনসাধারণকে লকডাউনে খাওয়ানো । এরা একটি অপরিহার্য শিল্পের শ্রমিক, তবে অপরিহার্য শ্রমিক নয়। স্বীকৃতি এবং সম্মানকে অস্বীকার করে, তাদের অবদানকে অবমূল্যায়ন বা উপেক্ষা করা হয়েছে। মহামারিতে বেশিরভাগ নিয়োগকর্তারা তাদের সুনামের ক্ষতি সীমিত করতে এবং ব্র্যান্ডের ইমেজ রক্ষা করতে দ্রুত মনোনিবেশ করেছে; অন্যদিকে কভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করতে এবং শ্রমিকদের সুরক্ষিত করতে ধীরে চলেছে।
এমনকি যদিও অনিরাপদ চাকরি শ্রমিকদের সুরক্ষাকে হ্রাস করে এবং তাদের আরও বেশি ঝুঁকির সামনে ফেলে দেয়, তথাপি আউটসোর্সিং এবং ক্যাজুয়ালাইজেশন বৃদ্ধি পেয়েছে। মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্প যেমন বিশ্বকে দেখিয়েছে: শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা লাভজনক; শ্রমিকদের সুরক্ষা নয়। এমনকি খাদ্য ও পানীয় কারখানায় মহামারির প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন দেশের সরকার ও নিয়োগকর্তারা ইউনিয়নকে আক্রমণ করছে এবং শ্রমিকদের ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য শাস্তি দেওয়ার প্রতিটি সুযোগ গ্রহণ করছে। ইউনিয়নগুলি যখন নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের অধিকারের জন্য লড়াই করছে, তখন তাদের সদস্যরা বিশ্বকে খাওয়াচ্ছে।
এই ক্রমবর্ধমান সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসাবে, বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তারকারী বিশ্বব্যাপী কৃষি-খাদ্য কর্পোরেশনগুলি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করতে এবং তাদের লাভ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। তারা যার ভিত্তিতে ব্যবস্থাটি পুনরুদ্ধার করতে চায় তা হ’ল উচ্চ মূল্যের ব্র্যান্ড এবং পণ্য; স্বল্প আয় এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য; উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং বিষাক্ত কীটনাশক; অস্থিতিশীল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি এবং পরিবেশ ধ্বংস। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা প্রতি বছর ত্রিশ মিলিয়ন কীটনাশক বিষের বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটায় যার ফলে ২৫০,০০০ বেশি লোক মারা যায়। এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ৮২০ মিলিয়ন মানুষ এই মহামারির আগেই অনাহারে জীবন যাপন করছিল, এবং যাকে “দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা” বলা হয় তার মুখোমুখি। দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য অনিরাপত্তায় ভোগকারীদের মধ্যে অন্যতম হ’ল কৃষি শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক এবং তাদের সম্প্রদায়। এরা বিশ্বকে খাওয়াচ্ছে, কিন্তু নিজেরা খেতে পারছে না।
মহামারির আগে বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থা সংকটে ছিল। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম চা ব্র্যান্ডগুলো এক কাপ ভালো চায়ের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে তবে চা বাগানের শ্রমিকদের পানি এবং স্যানিটেশন সম্পর্কিত মৌলিক মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করে। এমন একটি ব্যবস্থায় সুপারমার্কেটগুলি ছাড়ের মূল্যে কলার অর্ধেকেরও বেশি মূল্য গ্রাস করে থাকে, যখন কলা আবাদ শ্রমিকদের কীটনাশক দিয়ে বিষক্রিয়া করা হয় এবং ইউনিয়ন সংগঠনের জন্য নির্মমভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বিশ্বের সামুদ্রিক খাদ্য সরবরাহ ব্যাপক পরিমানে মৎস শিকার এবং যে কোনও পথে সমুদ্রের জীববৈচিত্র ধ্বংশের উপর নির্ভরশীল; একই সাথে মাছ ধরা জাহাজগুলিতে পাচার ও জোরপূর্বক শ্রমের এক নির্মম প্রচলিত ব্যবস্থা; এবং সামুদ্রিক খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় অনিরাপদ, অনিশ্চিত কাজ এর উপর নির্ভরশীল।
বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যা গ্রামীণ দারিদ্র্যের উপর নির্ভর করে ক্ষেত, খামার এবং প্লান্টেশনে ৯৮ মিলিয়ন শিশুদের শোষণ করার জন্য, অন্যদিকে প্রচলিত পিচ রেট মজুরির ব্যবস্থা শিশুদের বেচেঁ থাকতে পর্যাপ্ত পরিমাণে উপার্জনের জন্য তাদের বাবা-মায়ের পাশাপাশি কাজ করতে বাধ্য করে। কোন রকম বেঁচে থাকার মজুরি, জীবিকার জন্য ন্যায্য মজুরি নয়। পুরুষতন্ত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর দুর্বলতার উপর নির্মিত একটি ব্যবস্থা, যেখানে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার এতটাই প্রচলিত যে এটাকে ঘৃণ্য অপরাধ নয় বরং একে বলা হয় ‘সংস্কৃতি’। একটি ব্যবস্থা যা নারীদের প্রতি বৈষম্য করে এবং নারীদের প্রান্তিককরণ করে যারা – সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে – তাদের শক্তির দশগুণ বিশ্বকে খাওয়ানোর জন্য ব্যবহার করে। এমন একটি ব্যবস্থা যা মহামারিটির আগে স্পষ্টভাবে ভঙ্গুর ছিল। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা ঠিক করার দরকার নেই। এটি অবশ্যই প্রতিস্থাপন করা উচিত।
নীতিগত পরামর্শ, সরকারী কর্ম পরিকল্পনা এবং ভ্যাকসিনের প্রতিশ্রুতিগুলির সমস্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে, জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা (UNEP) ২০২০ সালের এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে এই মহামারিটি আমাদের দ্বারা সংগঠিত। এবং আমরা যেভাবে কৃষি উৎপাদন করি এবং বিশ্বকে খাওয়াই তা যদি পরিবর্তন না করি তবে আমরা পরবর্তী মহামারিটিও তৈরি করব।
UNEP রিপোর্টে মানুষের কার্যকলাপ এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে যা করোনাভাইরাস সৃষ্ট কভিড-১৯ জাতীয় রোগের উত্থান এবং বিস্তারকে বৃদ্ধি করবে। এই “রোগের চালকদের” মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ ধ্বংস, শিল্পায়িত কৃষি, প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদা এবং আমাদের খাদ্য সরবরাহ। অন্য কথায়, বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থা এই মহামারি তৈরি করতে সহায়তা করছে। এর সমস্ত খারাপ দিকগুলির মধ্যে অন্যতম এটি একটি রোগের চালক।
পরবর্তী মহামারি প্রতিরোধ করতে এবং বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করতে আমাদের অবশ্যই বিদ্যমান বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থাকে অবশ্যই পুননির্মাণ করতে হবে না, বরং আমাদের প্রয়োজন পরিবেশগত ও সামাজিকভাবে টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা দরকার যা নারীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা এবং অবদমন দূরীকরণে একটি টেকসই, ন্যায়বিচার এবং শান্তিপূর্ণ উপায় তৈরি করে।
আমাদের খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টির সার্বজনীন অধিকার থেকে শুরু করে সামাজিক সুরক্ষা এবং ব্যাপক অধিকারের ভিত্তিতে একটি টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা দরকার।
আমাদের অবশ্যই খাদ্য এবং পানীয় শ্রমিকদের অধিকারের সম্মান রক্ষা করতে হবে:
কর্মক্ষেত্রে চাকরি সুরক্ষা করা।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা।
কর্মক্ষেত্রে যৌথ দর কষাকষির প্রতি সম্মান করা।
কর্মক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি প্রদান করা।
সুরক্ষিত চাকরি + ইউনিয়ন অধিকার + নিরাপদ কাজ = নিরাপদ খাদ্য
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করতে,
আমাদের অবশ্যই খামারে, ক্ষেতে এবং বাগানে শিশু শ্রম বন্ধ করতে হবে।
আমাদের অবশ্যই খামারে, ক্ষেতে এবং বাগানে জোরপূর্বক শ্রম বন্ধ করতে হবে।
আমাদের অবশ্যই খামারে, ক্ষেতে এবং বাগানে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে।
আমাদের অবশ্যই খামারে, ক্ষেতে এবং বাগানে ক্ষতিকারক কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
আমাদের অবশ্যই খামার, ক্ষেতে এবং বাগানে পরিবেশের ধ্বংসের অবসান ঘটাতে হবে।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করতে,
খামার, ক্ষেতে এবং বাগানের শ্রমিকদের অবশ্যই খাদ্য ও পুষ্টির অধিকার থাকতে হবে।
খামার, ক্ষেতে এবং বাগানের শ্রমিকদের অবশ্যই ভূমি ও আবাসনের অধিকার থাকতে হবে।
খামার, ক্ষেতে এবং বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির অধিকার থাকতে হবে।
খামার, ক্ষেতে এবং বাগানের শ্রমিকদের অবশ্যই ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার থাকতে হবে।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করতে,
মৎস্য শ্রমিকদের অবশ্যই ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার থাকতে হবে।
মৎস্য শ্রমিকদের অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষার অধিকার থাকতে হবে।
মৎস্য শ্রমিকদের অবশ্যই নিরাপদ কাজের অধিকার থাকতে হবে।
মৎস্য শ্রমিকদের অবশ্যই জীবিকার জন্য ন্যায্য মজুরির অধিকার থাকতে হবে।
মৎস্য শ্রমিকদের অবশ্যই টেকসই মৎস্যখাত থাকতে হবে।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করতে,
প্রান্তিক কৃষক এবং খামার শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রয়োজন।
প্রান্তিক কৃষক এবং খামার শ্রমিকদের জীবিকার সুরক্ষা প্রয়োজন।
প্রান্তিক কৃষক এবং খামার শ্রমিকদের পরিবেশগত সুরক্ষা প্রয়োজন।
প্রান্তিক কৃষক এবং খামার শ্রমিকদের জলবায়ু কর্মোদ্যোগ প্রয়োজন।
বৈশ্বক খাদ্য সংকট প্রতিরোধ করতে অধিকার-ভিত্তিক, টেকসই বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের অবশ্যই যৌথ পদক্ষেপ নিতে হবে।